Wednesday, January 31, 2018

প্রতিদিন স্ত্রীকে সময় দেয়া

স্ত্রীদের সাথে কেমন ছিলেন তিনি (স:) - ১

তিনি প্রতিদিন স্ত্রীদের সময় দিতেন 

ইব্ন আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, ফজরের নামাজের পর রাসূল (স:) সূর্যোদয় পর্যন্ত নামাজের স্থানে বসে থাকতেন, এবং লোকেরা তাঁর চারপাশে বসে থাকত। এরপর তিনি একেএকে তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাদের সাথে কুশলবিনিময় করতেন, তাদের জন্য দুআ করতেন। এরপর যার ঘরে তাঁর সেদিনের পালা থাকতো, সেই স্ত্রীর ঘরে থাকতেন।

ভেবে দেখুন, রাসূল (স:) এরকম প্রতিদিন করতেন, এবং এটাই ছিল তাঁর দিনের প্রথম কাজ!

নবীজির (স:) স্ত্রীরা কখনোই মনে করতেন না যে তিনি কাছে নেই, কারণ তিনি তাদের সবার সাথেই প্রতিদিন দেখা করতেন। অথচ এখন এরকম কত স্বামীই আছে, যারা দিনের পর দিন, এমনকি মাসের পর মাস স্ত্রীকে ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, এমনকি পরিবারের খোঁজ খবরও রাখে না। 

আয়শা (রা:) বর্ণনা করেন, যখনই রাসূলুল্লাহ (স:) আসরের নামাজ শেষ করতেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর ঘরে যেতেন এবং তার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতেন।

আমাদের অনেককেই দেখা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাসার বাইরে বন্ধুদের সাথে বা কলিগদের সাথে আড্ডায় কাটায়। আর রাতে যখন ঘরে ফেরে, তখন সে ফুর্তি করে সম্পূর্ণ ক্লান্ত। তার পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো হয়তো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও ক্লান্ত হয়ে বিছানায় চলে যায়, মুহূর্তেই তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে। কোথায় আমাদের প্রিয় নবীজির (স:) সুন্দর পারিবারিক জীবনের আদর্শ, আর কোথায় আমরা।

[শাইখ সালেহ আল মুনাজ্জিদের Interactions of The Greatest Leader অবলম্বনে]

#কেমন_ছিলেন_তিনি 


Wednesday, November 22, 2017

সঠিক বুঝের সাথে দ্বীন মানা চাই

দ্বীনের জন্য যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে নিয়ত সহীহ হওয়া, সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি কাজটার ব্যাপারে আকীদা অর্থাৎ concept ঠিক হওয়া। অর্থাৎ যে কাজটা আমি করছি, শরীয়তের দৃষ্টিতে এটার অবস্থান কোথায়, এর গুরুত্ব কতটুকু?

দুটি সহজ উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন কেউ একেবারে নিয়ম অনুযায়ী নামাজ পড়ে। জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত, সেই সাথে সমস্ত সুন্নত, ইশরাক, চাশত, আওয়াবিন; তাহাজ্জুদেও উঠে পরে প্রায় রাতেই। এবং সে এই নামাজ আল্লাহ'র সন্তুষ্টির জন্যই পড়ে। কিন্তু সে মনে করে, এসব নামাজ আসলে না পড়লেও চলে। জামাত ছেড়ে দিলেও চলে, মাঝে মাঝে কাযা করেও চাইলে পড়া যায়! তো সে নিজে নামাজের পাবন্দী করছে ঠিকিই, কিন্তু নামাজের ব্যাপারে তার concept ঠিক নেই। এবং এই ভুল আকীদার কারণে তাকে জবাবদিহিও করতে হবে। শুধু নামাজ পড়লেই চলবে না, ফরজ নামাজকে ফরজ, সুন্নতকে সুন্নত জানতে হবে। আদায়ের লাভ জানতে হবে, ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি বুঝতে হবে।

এতো গেলো এক দিকের ভুল। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ কোনো জিনিসের সঠিক গুরুত্ব অনুধাবন না করা। এবার উল্টোদিকটাও দেখা যাক।

ধরুন কেউ হাফেজ হলো অনেক পরিশ্রম করে। সে কুরআনের একজন সংরক্ষক, কত মর্যাদার ব্যাপার! সেই সাথে সে এখন মাদ্রাসাতেও হিফযের উস্তাদ। ছোট ছোট ছাত্ররা তার হাত ধরে কুরআনের হাফেজ হচ্ছে। কত লাভজনক ব্যবসা! কিন্তু এই হাফেজ ভাই যদি ভেবে বসেন, কুরআনে হাফেজ হওয়া ফরজে আইন! যারা হেফ্জ করেনি, বা করার চেষ্টা করছে না, তারা সবাই ফরজ তরক করছে। যারা হিফযের জন্য সময় দিচ্ছে না, তাদের তো ইলমই নাই, তাদের ঈমানই অপূর্ণ! নিঃসন্দেহে এরকম ধ্যান ধারণা সম্পূর্ণ মূর্খতা। কুরআনে হাফেজ হওয়া অনেক ফজিলতপূর্ণ কাজ, হাফেজরা আল্লাহ'র কাছে কতই না প্রিয়। কিন্তু তাই বলে এই কাজকে ফরজ মনে করা, যারা হিফজ করেনি তাদেরকে ঈমান-ইলম হতে খালি মনে করা স্পষ্ট গোমরাহী। আর এজন্য এই ব্যক্তিও প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন।

সুতরাং দ্বীনের প্রতিটা কাজ, ছোট থেকে বড়, সঠিক ইলমের সাথে করতে হবে। সঠিক ইলমের ভেতরে একদিকে আছে সঠিক পদ্ধতি, আরেকদিকে সঠিক ধারণা। আর এই ইলম তো কেবল শেখা যাবে ইলমের ধারক-বাহকদের থেকেই!

আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।

Sunday, August 20, 2017

নূরের শহরে (৪) - রহমতে, বৃষ্টিতে, অশ্রুতে ভিজে

আল্লাহর ঘরের নিমন্ত্রণ পাওয়া, তাঁর ঘরেরতাওয়াফের তৌফিক পাওয়া, তাঁর হাবিবের সামনে দাঁড়াতে পারা এমনিতেই ছিল আমার জন্য হঠাৎ পাওয়া অবিস্বাশ্য নিয়ামত, তার উপরে আবার আল্লাহ আমাকে নিয়েছেন বাবা মায়ের সাথে, সুযোগ দিয়েছেন তাদের কিছু খেদমত করার। একদিকে আল্লাহর গুনাহগার বান্দা, অপরদিকে বাবা মায়ের হক আদায়ে ব্যর্থ সন্তান, তারপরেও এতবড় দান আল্লাহর তরফ থেকে, এতো ভালোবাসা বাবা মায়ের কাছ থেকে! কেবল উনাদের থেকেই আসলে আশা করা যায়!

তো এই সফরে বাবা মা যখন মসজিদে যেতেন, বা বাইরে কোনো কাজে, সাথে সাথেই থাকতাম। খাবারের সময় খুঁজে খুঁজে মনমতো খাবার নিয়ে আসতাম হোটেলে। তবে সকালের দিকে বা দুপুরের পরে, যখনিই তারা বিশ্রাম নিতেন, আমি ফুড়ুৎ করে প্রায় উড়ে চলে যেতাম নবীর মসজিদে! হোটেল থেকে নামলেই মসজিদে নববী, ইশ কত খুশির সময় ছিল! এ সময়গুলো আমি চড়ে বেড়াতাম প্রিয় নবীর মসজিদের জমিনে। কিছুটা দ্বীনি শিক্ষা বা উপলব্ধি যাদেরকে আল্লাহ দিয়েছেন, তারা এই মসজিদের মর্যাদা বুঝেন। আরেকটু যারা আগে বেড়েছেন আল্লাহর দিকে, তারা টের পান এই মসজিদের নূর, এখানের রুহানিয়াত। অদৃশ্য জগতের আয়োজন সবার চোখে না পড়লেও, এখানের বাহ্যিক সাজসজ্জা চোখ এড়াবে না কারোরই। এখানের চোখ ধাঁধানো আর্কিটেকচার, ডেকোরেশন, লাইটিং দেখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। সেই সাথে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য আছে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। তবে আমাদের বড়োরা এসব জাঁকজমকের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেন। করারই কথা। প্রিয় মানুষকে আমাদের চোখে সুন্দর লাগে তার প্রতি মহব্বতের কারণে, আর তার গায়ের অলংকার সেই সৌন্দর্যকে একটু বাড়িয়ে দেয় কেবল। তবে সব আকর্ষণ যদি হয় ওই গলার হারের দিকেই, প্রশংসা যদি হয় শুধু হীরার আংটির, তবে কি সে খুশি হবে? হওয়ার কথা না।

আমার কাছে মনে হতো, এখানে এক এক জায়গায় বসে থাকা, নামাজ পড়া, তিলাওয়াত করার যেন এক এক রকম স্বাদ। রাসূল (স)-এর সময় তো মসজিদ এতো বড় জায়গা জুড়ে ছিল না, কিন্তু এই পুরো জায়গাটাই তো ছিল মসজিদের আশেপাশে। এসব স্থানে নিশ্চই পড়েছে আমার প্রিয় নবীজির পায়ের ছাপ! এসব জমিনে নিশ্চই ঘুরে ফিরেছেন আল্লাহর প্রিয়, নবীর প্রিয় সাহাবীরা। যুগ যুগ ধরে আল্লাহর সব প্রিয় বান্দাদের পা পড়েছে এসব মাটিতে, গুঞ্জন উঠেছে তাদের তিলাওয়াতের, জিকিরের, আল্লাহর বড়ত্বের আলোচনার; দরস হয়েছে কুরআনের, হাদিসের, ফিক্হের! তাই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো মসজিদ, এ মাথা থেকে ও মাথা, প্রতিটি কোণে, যতবেশি সম্ভব। কখনও নামাজে, কখনো তিলাওয়াতে, কখন দুআয়; কখনো শুধুই বসে থেকে, কখনো একটু বিশ্রামে। এরকম একটু বিশ্রাম নিতে গিয়ে আজব অভিজ্ঞতা হলো একবার। মসজিদে নববীতে মূল সবুজ গম্বুজ ছাড়াও আরও কিছু গম্বুজ আছে। প্রশস্ত এলাকা জুড়ে মাথার উপর ছায়া করে আছে নজর কাঁড়া কারুকার্য করা এসব গম্বুজ। একবার খুব সম্ভবত বেশ ভোরে, সূর্য তখনও বেশি উপরে উঠেনি। মসজিদের এরকম একটা গম্বুজের নিচে বসে আছি, আশেপাশে মুসল্লিরা তেমন কেউ নেই। ভাবলাম একটু লম্বা হই। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম কার্পেটের উপর, মাথার উপর বিশাল গম্বুজ। চোখ বন্ধ করতেই কখন যেন ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুম ভাঙলো কিছু পরে। চোখ খুলে আমি হতবাক, কোথায় আসলাম? ছিলাম শুয়ে গম্বুজের ছায়ায়, এখন দিকে মাথার উপর নীল আকাশ, গায়ে এসে পড়ছে দিনের আলো! একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা। এগুলো মসজিদের কিছু অত্যাধুনিক গম্বুজ। প্রতিদিন কিছু নির্দিষ্ট সময় আলো বাতাস প্রবেশের জন্য এগুলো নিঃশব্দে স্লাইড করে সরে যায় মসজিদের ছাদের উপর! আমার উপরেরটাও সেরকম সরে গেছে আমি ঘুমিয়ে থাকতে! সুবহানাল্লাহ!

এই মসজিদের কিছু জায়গা তো আছে অন্য সব অংশ থেকে স্পেশাল। 'জান্নাতের বাগানে' তো আল্লাহ চড়িয়েছেন সেই প্রথম রাতেই! এছাড়া রাসূল (স) এর রওজা শরীফের যে দিকে 'ক্বাদামাইন শারিফাইন' অর্থাৎ আল্লাহর হাবিবের মুবারক পা দুখানি, সে দিকের রওজার দেয়াল আর মসজিদের দেয়ালের মাঝে অল্প একটু জায়গা আছে। এখানেও ভিড় লেগে থাকে নামাজ পড়ার জন্য, অল্প সময় বসে আল্লাহর কাছে দুআ করার জন্য। এখানেও সময় কাটিয়েছি বেশ কিছুক্ষন। আরও আছে আসহাবে সুফ্ফার প্লাটফর্ম। নবীজির প্রিয় কত সাহাবী এখানে থেকেছেন আল্লাহর রাসূলের সোহবতে! (বর্তমান প্লাটফর্মটা অবশ্য তখনকার পজিশনে নেই, তার থেকে একটু পেছনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে)

মসজিদের একেবারে সামনের অংশটা পুরোনো, তুর্কি আমলের। এই অংশে নামাজ পড়তেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো, যদিও এখানে মুসল্লিদের ভিড় একটু বেশিই থাকে সবসময়। তবে যদি জানতে চান, পুরো মসজিদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা আমার কাছে কোনটি, তাহলে আপনাকে নিয়ে যাই এই পুরোনো অংশের আরেকটু পেছনের দিকে। মসজিদের মধ্যেই এখানে আছে একটা খোলা চত্বর। আর এখানেই বসে থাকতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো আমার। চারপাশে ঘিরে আছে মসজিদের দালান। সারি সারি পিলার আর আর্চগুলো চলে গেছে যেন দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত, দুপাশে আর পেছনে। কাতারের লাল কার্পেটগুলো এখানেও বেছানো আছে মার্বেলের ফ্লোরের উপর। তবে মাথার উপরে ছাদ নেই, আছে খোলা আকাশ! আর সামনে? সামনেই মসজিদের তুর্কি আমলের, ভাব-গাম্ভীর্যে পূর্ণ পুরোনো অংশ। বামপাশে কোণাকুণি তাকালেই চোখে পরে রওজা শরীফের গাঢ় সবুজ দেয়াল, সোনালী জালি। আর ঠিক সেই বরাবর উপরে, নীল আকাশের গায়ে ঝলমল করছে সবুজ গম্বুজ! এরকম একটা পরিবেশের মাঝে বসে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে প্রিয় হাবিবের দেয়ালের দিকে, ওই গম্বুজের সবুজের দিকে।

প্রয়োজনে ছায়ার ব্যবস্থা আছে অবশ্য। উঁচু উঁচু পিলারগুলোর গায়ে লুকিয়ে আছে অত্যাধুনিক ছাতা। এই ছাতাগুলো ছড়িয়ে আছে মসজিদের বাইরের চত্বরেও। রোদ-বৃষ্টিতে প্রয়োজনে এসব ছাতা ছড়িয়ে যায় পিলার থেকে, আস্তে আস্তে খুলতে থাকে, মাঝ থেকে বাইরের দিকে। তবে খোলা অবস্থায় ছাতাগুলো সাধারণ ছাতার মতো বৃত্তাকার নয়, বরং চারকোণা। মসজিদের মাঝের এই চত্বরের ছাতাগুলো যখন মেলে দেয়া হয়, এদের কোণগুলো প্রায় মিলে যায় একটা আরেকটার সাথে, একেবারে মসজিদের ছাদ বরাবর। ছাতাগুলোর মাঝের ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যায় আকাশ। প্রযুক্তির ব্যবহার আছে, কিন্তু প্রকাশ নেই। ছাতাগুলোর ডিজাইন মসজিদের আবহের সাথে মিশে যায় একেবারেই।

আর এই প্রিয় উন্মুক্ত চত্বরে, ছাতার নিচে একদিন পেলাম আরেকটা স্মরণীয় উপহার।

আসর পড়ার জন্য মসজিদে এসেছি। সেই ওয়াক্তে বাবা খুব সম্ভব বেশ ক্লান্ত ছিলেন, মসজিদে আসেনি। বাবার সাথে থাকলে তাকে নিয়ে এতটা ভেতরে আসতাম না, অনেক হাটতে হয় বলে। একা থাকলে আমি প্রায়ই নামাজে দাঁড়াতে চেষ্টা করতাম সামনের অংশের কোথাও। সেদিন দাঁড়ালাম এই খোলা চত্বরে। আকাশে মেঘ ছিল, সে জন্যই ছাতাগুলো পুরোপুরি মেলে আছে। জামাতের ইকামত হলো, নামাজে দাঁড়ালাম ছাতার নিচে। কিছুক্ষন পরেই শুনতে পেলাম শব্দটা, প্রথমে থেমে থেমে, অল্প অল্প। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো, বাড়তেই থাকলো। হ্যা, ছাতার উপর বৃষ্টির শব্দ! অল্প সময়ের মধ্যেই ঝুম ঝুম করে পড়তে শুরু করলো বৃষ্টি। ছাতাগুলোর মাঝের ফাঁকা দিয়ে বৃষ্টি আসছে মসজিদের ভেতর, ভিজে যাচ্ছে কার্পেট, ভেসে যাচ্ছে মার্বেলের মেঝে! আরেকটু পরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগলো ছাতার কাপড় চুয়ে চুয়ে। নামাজের মধ্যেই ভিজে যাচ্ছি বৃষ্টিতে! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! আমাকে যদি চিনে থাকেন (যেটার সম্ভাবনা কম), বা আমার লেখা আগে পড়ে থাকেন (সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), তাহলে নিশ্চয়ই জানেন বৃষ্টি আমার কত প্রিয়। আমার অন্যতম প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে কয়েকটা হলো বৃষ্টি দেখা, বৃষ্টির শব্দ শুনা আর বৃষ্টিতে ভেজা। কিন্তু কখনও কি কল্পনাও করেছি আমি ভিজবো এরকম এক জায়গায়? দাঁড়িয়ে আছি আল্লাহর হাবিবের মসজিদে, সামনেই প্রিয় নবীজির রওজা, সবুজ গম্বুজ; চলছে আসরের জামাত। একটু পর পর ইমাম সাহেবের গম্ভীর স্বরে তাকবীর, মুয়াজ্জিনের সুরেলা প্রতিদ্ধনি, আর সেই সাথে বৃষ্টির রিমঝিম। রহমতের পানি নামছে আকাশ থেকে, মসজিদে নববীর উপর ভেসে বেড়ানো, আল্লাহর পাঠানো মেঘ থেকে, এসে পড়ছে ছাতার উপর। এই ছাতা তো মসজিদেরই অংশ, মসজিদেরই ছাদ! রহমানের পাঠানো রহমতের বৃষ্টি, রহমতের নবীর মসজিদের ছাদ ফুঁড়ে এসে পড়ছে আমার মতো এক অযোগ্য বান্দার শরীরে! বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কিয়াম, রুকু; বৃষ্টি ভেজা মেঝেতে কপাল রেখে সিজদা! আল্লাহই জানেন, একমাত্র তিনিই জানেন, ওই মুহূর্তটা, ওই চার রাকআতের সময়টা আমার কাছে কত প্রিয় ছিল! হয়তো খুশির অশ্রু মিশেও গিয়েছিল বৃষ্টির পানির সাথে। নামাজ শেষ হতেই দেখা গেলো ছোটাছুটি, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সরে যাচ্ছে মুসল্লিরা, কার্পেট গুটানো হচ্ছে দ্রুত গতিতে। আমি বসেই থাকলাম অনেকক্ষণ। উঠে পড়লেই শেষ হয়ে যাবে এই উপহার, এই স্মৃতি। বৃষ্টি কমে এলো কিছু পরে। ততক্ষণে ভিজে গেছি ভালো মতো।

তবে উদ্ভট একটা দৃশ্যও দেখতে হলো এই সময়ে। এক মুসল্লি ভাই, দেখে মনে হলো আমাদের এই উপমহাদেশেরই কেউ হবেন নিশ্চই। পুরো নামাজ চলাকালীন সে বসে থাকলো, নামাজ না পড়ে। বৃষ্টির ফোঁটা যেখানে যেখানে পড়ছে, সেসব ফোঁটায় আঙ্গুল দিয়ে বৃষ্টির পানি নিজের চেহারায় মাখছে। নামাজ শেষে হওয়ার পরও সেই এই কাজই চালিয়ে গেলো অনেক্ষণ। দ্বীনের ক্ষেত্রে আবেগ বেশ উপকারি, এই আবেগের কারণে অনেক বাহ্যত কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়, প্রিয় হয়ে যায়। তবে এই আবেগও হতে হবে শরীয়তের দেখানো সীমার মধ্যে। তা না হলে সেটা আমাদের উল্টো পথে নিয়ে যেতে পারে সহজেই। এজন্যই দ্বীনের উপর চলা শিখতে হবে দ্বীনের বুঝমান আলেমদের থেকে, আল্লাহওয়ালাদের দেখানো পথে। উনারাই দেখিয়ে দিতে পারেন কিভাবে এই আবেগকে কাজে লাগাতে হবে জান্নাতের পথে এগোতে।

দ্বীনের ক্ষেত্রে সঠিক আকিদা, নিয়মনীতি, পদ্ধতি জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আরেকটা জিনিস, যেটা আজকের যমানায় অনেক বেশি দুর্লভ। আর সেটা হলো আদব। দ্বীন সম্পর্কে যাদের এখনো বেশি জানার সুযোগ হয়নি তাদের কথা বাদই দিলাম, খোদ যেসব মানুষদের আমরা দ্বীনদার বলে মনে করি, তাদের ভেতরেও এই আদবের বড় অভাব আজকে। যাদের দিলে আল্লাহর আজমত, তাঁর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্বের একীন আছে, আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মহব্বত, তারাই পারেন আল্লাহর ঘরের, নবীর রওজার আদব রক্ষা করতে। তাই আদব শিখে নেয়া দরকার আলেমে দ্বীনদের থেকে, আল্লাহওয়ালা বুজুর্গদের থেকে। এসব পবিত্র স্থানে তাদের আদবের নমুনা পেতে আবু তাহের মিসবাহ সাহেবের 'বাইতুল্লার মুসাফিৱ' পড়া যায়। কি অনুভূতি, কি আবেগ, কি শ্রদ্ধা, আদবের প্রতি কি পরিমাণ যত্নশীল হয়ে এসব স্থানে আসেন উনারা।

আর আদবের শিক্ষা না থাকলে কি হতে পারে তা স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে আমাকে বহুবার, মক্কা ও মদিনায় ওই অল্প কয়েকদিনে। মসজিদের ভেতরের কথা বাদই দিলাম, একেবারে রওজা পাকের সামনে দাঁড়িয়ে চলছে গল্প, হাসাহাসি। ভিডিও হচ্ছে অনবরত, কেউ আবার সেলফি তুলছেন নবীজির রওজাকে পেছনে রেখে! খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলে রাখতাম এসব দেখে দেখে। তবে মদিনা সফরের শেষের দিকের একবার যিয়ারতে একটু বেশি আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম। সালাম পেশ করার জন্য এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে লাগলাম মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, চলছে ভিডিও, সেলফির অত্যাচার। কষ্টটা বাড়তে থাকে যত এগুতে থাকি সামনের দিকে। নবীজির রওজা শরীফের একেবারে কাছে যখন চলে এসেছি, তখন সামনে বেশ কয়েকজনের মোবাইল উঁচু করে ধরা, ছবি উঠছে। নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না আর। চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো। সামনের ভাইয়েরা অধিকাংশই আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের। ভাঙা হিন্দি-উর্দুতে বলে উঠলাম কান্না নিয়ে, এখানে ছবি না উঠাই, সামনেই আল্লাহর রাসূল শুয়ে আছেন। বন্ধ করুন প্লিজ! আমার সামনেই ছিলেন খুব সম্ভবত পাকিস্তানী এক ভদ্রলোক, আমার চাচাদের বয়সী হবেন। ফটো তুলছিলেন তিনিও। আমার কথা শুনে ফিরে তাকালেন, খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমি বললাম, আমাকে ভুল বুঝবেন না। তিনি বললেন, না না, তুমি তো ঠিকই বলেছো! এরকম করা আমাদের উচিত না। খুব তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক মোবাইলটা পকেটে ঢুকালেন। কিছু মানুষ এখনো আছে যারা সহজে ভুল স্বীকার করতে পারে। তবে এদের সংখ্যা খুব, খুব কম।

এভাবেই কেমন করে যেন চলে এলো বিদায়ের দিন। হায়, এই দিনেরই তো ভয়ে ছিলাম আমি, মদিনায় আমাদের প্লেন নামার পর থেকেই। এই দিনের ভয়েই তো চোখে পানি এসে গিয়েছিলো প্লেনের সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে! ভালো সময়, শান্তির সময়, সুখের মুহূর্তগুলো এতো দ্রুত কেন চলে যায়? সময়ের আপেক্ষিকতা কি একেই বলে? মদিনা থেকে যাবো মক্কায়, উমরার জন্য। একদিকে সফরের প্রস্তুতির ব্যস্ততা, অন্যদিকে উমরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি, বাইতুল্লাহর তাওয়াফের প্রতীক্ষা, এক্সাইটমেন্ট। তাই মদিনাকে বিদায় বলার কষ্টটা কিছুটা হলেও হয়তো কমে গিয়েছিল, সহনীয় হয়েছিল। মদিনা থেকে রওনা হওয়ার আগে প্রিয় নবীজির রওজায় শেষ যিয়ারতের সময় বাবার সাথে ছিলাম। দুজনেরই চোখ ভেজা! আবার কি আসব? সুযোগ হবে কি? এতো বড় সৌভাগ্য কি আবার আসবে জীবনে? এতো এতো উপহার কি আবারো আমাকে দিবেন আল্লাহ? বাবা মায়ের স্নেহের হাত ধরে, আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, আবার কি আসা হবে নবীর মসজিদের মেহমান হয়ে?

আসবো, অবশ্যই আসবো ইনশাআল্লাহ। এই মসজিদে বসে বসে অনেক চেয়েছি এবার, আল্লাহ যেন আবার আনেন, বার বার আনেন, এখানেই যেন রেখে দেন! যেই আল্লাহ না চাইতে এতো দিলেন, তিনি চাইলে কি করে না দিয়ে পারবেন? অবশ্যই দিবেন। দিতেই হবে!


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------

লেখাটা যখন পোস্ট করছি, সেই unforgettable উমরার সফরের এক বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। এবং ইনশাআল্লাহ আর মাত্র চারটি দিন পরেই রওনা হবো আবার! সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ এবছর আবারও ডেকেছেন তাঁর ঘরে, তাঁর বাইতুল্লাহর দরজায়, তাঁর হাবিবের দুয়ারে! উমরাহ নয় শুধু, একেবারে হজ্বের সফর! ইহরাম জড়িয়ে, লাব্বাইক বলে বের হয়ে যাবো ঘর থেকে! সাথে এবার আমার জীবনে নতুন এক মানুষ, আমার স্ত্রী! হজ্বের আহকাম, দ্বীনের শিক্ষা, আমল আর আদব এবার দেখে দেখে শিখবো আমাদের সফরসঙ্গী উলামা হজরতদের থেকে, বিশেষ করে আমার প্রিয় হজরত হামিদুর রহমান স্যারের কাছ থেকে। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহর কাছে উপহারের এতো ভান্ডার? আবারো, এতো বড় করে খুলে গেলো আমার সৌভাগ্যের দরজা?  আল্লাহ তুমি অনেক বড়, অনেক প্রিয়, আমাদের তুমি অনেক ভালোবাসো!

বলেছিলাম না, আল্লাহ দিবেন? দিতেই হবে! বিশ্বাস হয় না? একবার চেয়েই দেখেন না চাওয়ার মতো।

বান্দা চাইলে, না দিয়ে তিনি পারবেন?


Friday, August 11, 2017

নূরের শহরে (৩) - আল্লাহর দুই বান্দা

মাসজিদুল হারাম আর মাসজিদে নববী। আল্লাহর আশিক যারা, আল্লাহর সন্তুষ্টি যারা খুঁজে ফেরেন, আল্লাহর হুকুমের যারা পাবন্দ, নবীর সুন্নাতের যারা অনুসারী; আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা যাদের অন্তরে বদ্ধমূল, পৃথিবীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এমন বান্দারা প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন এই পবিত্র জমিনে। এই দুই শহরের আলো বাতাসে, এই দুই মাসজিদের ছায়ায় আসতে না পারলে তাদের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেক বোকারা ভাবে, হজ্ব তো ফরজ একেবারই, এতবার যাওয়ার কি আছে? যিয়ারতের জন্য তো একদিনই যথেষ্ট, এতদিন মদিনায় কি দরকার? যাদের অন্তরে আল্লাহর মহব্বত নেই, যাদের কাছে ইসলাম মানে শুধুই কিছু নিয়মতান্ত্রিক কাজ, যেগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয়, তারা কী বুঝবে কাবার দিকে তাকিয়ে থাকার আনন্দ? যাদের কাছে নবীজি কেবলই একজন বার্তা বাহক, যাদের অন্তরে নেই আমাদের প্রিয় নবীর ভালোবাসা, নেই তাঁকে দেখার তামান্না, তারা কী বুঝবে যিয়ারতের জন্য ধীর পায়ে হেটে যাওয়ার সময় মনের অবস্থা? তাদের দিলে এসবের কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু যাদের দিলকে আল্লাহ তাঁর নিজ রহমতে সজীব রেখেছেন, সেখানে ঢেলেছেন তাঁর মহব্বত, তাঁর হাবিবের মহব্বত, তারা তো এখানে আসবেই! বার বার আসবে। তাই এই পবিত্র দুই আঙিনায় খুঁজে পাওয়া যায় আল্লাহর এসব প্রেমিকদের। যদি কেউ খুঁজতে চায়।

সেরকমই এক বান্দার দেখা পেয়ে গেলাম প্রথম দিনই। মাগরিবের নামাজের জন্য মাকে পৌঁছে দিয়েছি মহিলাদের নামাজের অংশে। আমি আর বাবা চলে এসেছি মসজিদের বেশ ভেতরের দিকে। মাগরিব আর এশার মধ্যে গ্যাপটা খুব বেশি না, তাই মাগরিব পরে মসজিদেই আমলে বসে থাকলাম। বাবার জন্য লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকা, বা মেঝেতে বসে থাকাও কষ্টকর। উনি বসে আছেন চেয়ারে, কুরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত। আমি বাবার পেছনেই বসে আছি, মাঝে মাঝে হাটাহাটি করছি। এমন সময় চোখ গেলো আমাদের থেকে কয়েক কাতার সামনের দিকে। হুইলচেয়ারে বসে আছেন একজন বয়স্ক লোক। একটু সামনে এগিয়ে ভালো করে দেখলাম। সাদা ধবধবে আপদমস্তক। মাথায় সাধারণ পাঁচ-কলি টুপি, গায়ে সাদা সুন্নতি লেবাস। পায়ের সালোয়ার 'নিসফে সাক' অর্থাৎ হাটু আর গোড়ালির মাঝ বরাবর। পুরোটাই ধবধবে সাদা। আর এমন উজ্জ্বলতা কখনও কি দেখেছি কারও চেহারায়? লালচে ফর্সা চেহারাটা ঢেকে আছে মুখভর্তি সাদা দাঁড়িতে। অসম্ভব সুন্দর, শান্ত সেই মুখ। মানুষটাকে দেখা মাত্রই একটা কথাই মনে হলো, ইনি আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা। উনার সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে। আজব একটা আকর্ষণ আমাকে টেনে নিয়ে গেলো সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটার দিকে।

উনার আশেপাশে দেখলাম সুন্নতি লেবাসে কয়েকজন বসে আছেন, স্পষ্টতই তারা আমাদের আশেপাশের কোনো দেশের, এবং ওই মুরব্বির মুরিদ। পেছনে বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,

- উনি কি আপনাদের শায়খ?
- জি
- উনার পরিচয় ?
- উনি তো ফিরোজ মেমন সাহেব, হাকিম আখতার (র) এর খলিফা।

সুবহানাল্লাহ! ফিরোজ মেমন সাহেবের নাম তো আমি শুনেছি আগেই। আর পাকিস্তানের হজরত হাকিম মুহাম্মদ আখতার সাহেব (র) এর নাম না জানা কি সম্ভব? এখন তো তার সাথে হাত না মিলিয়ে যেতে পারবো না!

- আমি উনার সাথে মুসাফাহা করতে পারি ?
- অবশ্যই, কেন নয় ?

পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে হজরতের সামনে গিয়ে বসলাম, সালাম দিয়ে মুসাফাহা করলাম। অসম্ভব আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে তার নরম হাতের মধ্যে নিয়ে নিলেন আমার হাত। কি প্রশান্তি ছিল উনার সেই হাসিতে, সেই মুসাফাহায়! হযরতকে পরিচয় দিলাম, বললাম আমার বাবা মায়ের সাথে এসেছি বাংলাদেশ থেকে। খুব খুশি হলেন। সেই সাথে ঢাকার কোনো একজন বড় আলেমের নাম বললেন, এখন মনে নেই, যার সাথে উনার খুব ভালো ইসলাহী সম্পর্ক। হজরতের কাছে দুআ চেয়ে ফিরে আসলাম আগের জায়গায়। এসেই বাবাকে বললাম, ঐ যে উনি একজন আল্লাহওয়ালা, পাকিস্তানের বুজুর্গ ব্যাক্তি। উনার এপিয়ারেন্স বাবাকেও মুগ্ধ করেছিল। বাবা বললো, চল সালাম দিয়ে আসি। বাবাকে নিয়ে গেলাম হজরতের কাছে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হজরত তার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার সাথে মুসাফাহা করলেন, শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিলেন, বিনয়ের সাথে। দুই মুরব্বির হাসিমাখা মিলনের দৃশ্যটা খুবই সুন্দর ছিল। একটু পরে বাবা বললেন, এটা আমার ছেলে, কিছুদিন পর ওর বিয়ে ইনশাআল্লাহ, ওদের জন্য বিশেষ দুআ চাই। হজরত খুশি হয়ে আমার দিকে ফিরলেন, দুআ করলেন। সুবহানাল্লাহ! যার বিয়ে তার নিজের তো খবর ছিল না এব্যাপারে দুআ চাইতে, অথচ বাবার মাথায় ঠিকই ছিল। আসলে বাবা-মায়েরা এমনই হয়। ছেলে মেয়েদের ভালো থাকা, খুশি থাকা নিয়ে চিন্তা তাদের মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরে যায় না।

رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

আল্লাহর আরেক আশেক বান্দা, দ্বীনের এক একনিষ্ট খাদেম, আমার অসম্ভব প্রিয় এক ব্যক্তিত্বের সাথেও আল্লাহ মিলিয়ে দিয়েছিলেন তার পরের দিনই। যোহরের নামাজের পর মসজিদ থেকে বের হচ্ছি। হোটেলে ফিরে যাবো, আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কোন দরজা দিয়ে বের হচ্ছিলাম সেটা এখন মনে নেই। গেটের বেশ কিছু দূর থেকেই গেটের কাছে কয়েকজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, কথা বলছেন। এতদূর থেকে চেহারা স্পষ্ট না দেখা গেলেও, একজনের অবয়ব পরিচিত মনে হলো। হ্যা সেরকমই তো পোশাক, চোখে চশমা, দাড়িও সেরকম হালকা লালচে। মাঝারি গড়নের, যেমনটা দেখেছিলাম আগে একবার। উনি কি তবে.......???

Bucket List এর সাথে পরিচিত আছেন? জীবনে আপনি কি কি করতে চান, মৃত্যুর আগে? পৃথিবীর কোন কোন সৌন্দর্য আপনি ঘুরে দেখতে চান? কি ধরণের adventurous কাজ করতে চান, অন্তত একবার হলেও? এরকম টার্গেটের লিস্টকে Bucket List বলে। আমার এরকম একটা লিস্ট আছে। জীবনে অন্তত একবার হলেও, যেসব মানুষের সাথে আমি সাক্ষাৎ করতে চাই, কথা বলতে চাই, এরকম মানুষদের একটা লিস্ট। এই লিস্টে আছেন এমন কিছু মানুষ, যাদের influence আমার জীবনে অনেক। যাদের লেখনী, যাদের লেকচার আমার নিজের মানসিকতা গঠনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে আমার দ্বীনী understanding, দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে আমার concept, অর্থাৎ বুঝ-সমঝের ক্ষেত্রে এসব মানুষের অবদান অনেক। দ্বীন মানা এক জিনিস, আর দ্বীনের বুঝ অন্য জিনিস। আর এই দ্বিতীয়টার গুরুত্ব অনেক বেশি। যেসব দ্বীনি ব্যক্তিদের কথা, লেখা আমাকে শিখিয়েছে কুরআনের শিক্ষা, হাদিসের শিক্ষা, তাদের কাছে আমি চির ঋণী। আর উনাদের তালিকায় একেবারে প্রথম দিকেই যার নাম, তিনি মুফতি ত্বকী উসমানী।

বর্তমান সময়ে যারা দ্বীনের উপরে কিছুটা হলেও চলার চেষ্টা করছেন, শেখার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যে মুফতি ত্বকী সাহেবকে চেনেনা এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। উনার কেবল পরিচয় তুলে ধরতেও কয়েক পৃষ্ঠা লেগে যাবে। দ্বীনের কোন শাখায় নেই উনার কন্ট্রিবিউশন? একদিকে উনি ফিকহ এবং হাদিসের অনেক বড় উস্তাদ, পড়াচ্ছেন দারুল উলুম করাচিতে। ইসলামী অর্থনীতিতে তিনি সারা পৃথিবীতে একজন লিডিং রিসার্চার। উনার সম্মানিত পিতাও ছিলেন সারা দুনিয়ায় সুপরিচিত একজন আলেমে দ্বীন, মুফতি শফি উসমানী (র)। বাপকা বেটা যাকে বলে। মুফতি ত্বকী সাহেব হাদিসের সনদ পেয়েছেন যাদের থেকে তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন শায়খ যাকারিয়া (র), মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (র), ক্বারী তৈয়ব সাহেব (র) এবং মাওলানা সলিমুল্লাহ খান (র)। এখানেই শেষ না। তাজকিয়ার মেহনতেও আছেন প্রথম সারিতে। হাকীমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানভী (র)-এর দুজন বিশিষ্ট খলিফা ড. আব্দুল হাই আরিফী (র) এবং মাওলানা মাসীহুল্লাহ খান (র) এর খেদমতে থেকে সুলূকের পথে হেঁটেছেন। দুজনের থেকেই খিলাফত লাভ করে আত্মশুদ্ধির পথ দেখাচ্ছেন অগণিত মুসলিমদের, যারা উনার হাতে বায়আত হয়েছেন। এসব দ্বীনি ব্যস্ততা সত্ত্বেও আইনে পড়াশোনা করেছেন, পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছেন! এছাড়া লিখেছেন আশিটিরও অধিক দ্বীনি কিতাব; উর্দু, ইংরেজি এবং আরবি ভাষায়। সুবহানাল্লাহ! একেই বলে বরকত। আমার দ্বীনি বুঝ-সমঝ গঠনে উনার বয়ান, লিখিত বই এবং প্রবন্ধের ভূমিকা অনেক বেশি। কয়েক বছর আগে উনার একটা বয়ান সরাসরি সামনে বসে শুনার তৌফিক হয়েছিল ঢাকায়। অল্প সময়ের সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো এখনো গেথে আছে আমার মন-মস্তিষ্কে, আশা করি থাকবে সারা জীবন। তবে সেবার উনার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি, তাই একটা আফসোস ছিল মনে মনে।

গেটের আরেকটু কাছে যেতেই আর সন্দেহ থাকলো না। দাঁড়িয়ে আছেন মুফতি ত্বকী উসমানী সাহেব! সাথে আরো দুই জন। অনেকটা মন্ত্র মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। হজরত খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কথা বলছিলেন বাকিদের সাথে, চেহারার এক্সপ্রেশন খুবই সিরিয়াস। তারপরও সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। দুহাতে মুসাফাহা করলেন হজরত, সালামের উত্তর দিলেন। ইচ্ছা হচ্ছিলো কিছু কথা বলতে, দুআ চাইতে, কিন্তু আমি ঢুকে পড়েছি তাদের conversation এর মধ্যে, তাও বেশ সিরিয়াস বিষয়ে নিশ্চয়ই। তাই আর দেরি করলাম না, প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনাদের ছেড়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আল্লাহর দেয়া হঠাৎ এই সুযোগ বিশ্বাস করতেও সময় লাগলো কিছুক্ষণ। আমি আসলেই মুফতি ত্বকী সাহেবের সাথে হাত মেলালাম? আলহামদুলিল্লাহ। সেই সাথে আবার আফসোসও হলো, এতো কাছে এলাম, মুসাফাহা হলো, কিন্তু কথা হলো না, দুআ চাওয়া হলো না? মিশ্র একটা অনুভূতি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

কাহিনী এখানেই শেষ হলেও সেটা হতো অন্যতম স্মরণীয় একটা ঘটনা। তবে এই গল্পের ২য় পর্ব যে এখনো বাকি, সেটা আমি কিভাবে জানবো?

এশার নামাজ পড়লাম মসজিদের পুরোনো অংশে, অর্থাৎ একেবারে সামনের দিকে। বাবুল সালাম থেকে বাবে বাকি'র দিকে যিয়ারতের যে রাস্তা, তার ঠিক পেছনে সারি সারি শেলফ আছে সোনালী রঙের, কোরআনের মুসহাফ রাখা। এরকমই একটা শেলফের পেছনে এশা পড়লাম। জামাত শেষ হলো, সুন্নতের জন্য দাঁড়ালাম একটু দেরি করেই। তখন জায়গায়টায় মুসল্লিদের চাপ কমে গেছে অলরেডি। আমার দুপাশে কেউ নেই। বিতর নামাজ পড়ছি, ঠিক পাশেই একজন এসে দাঁড়ালেন নামাজে। ভদ্রলোক যখন রুকুতে গেলেন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার এপিয়ারেন্সের দিকে নজর গেলো। কি ব্যাপার? মনে তো হচ্ছে ...... । সালাম ফিরিয়ে ঝট করে পাশে তাকালাম। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আমার ঠিক পাশে নামাজ আদায় করছেন শায়খ ত্বকী উসমানী! এতটা সৌভাগ্য আমার কপালে কিভাবে জুটলো? এতো বড় মসজিদে নামাজ পড়ার জায়গার কোনো অভাব নেই। আমার প্রিয় মানুষটা এসে দাঁড়ালেন ঠিক আমারই পাশে?

হজরতের নামাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করলাম। উনার ব্যাপারে একটা কথা আগেই শুনেছি কার কাছে যেন। মা'মুলাত অর্থাৎ নিয়মিত আমলের ব্যাপারে উনি এতটাই punctual, যেন আমলটা তখন না করলে আর করাই হবে না। আমলের দিকে এমনভাবে ছোটেন, যেন ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এবার দেখতে পেলাম স্বচক্ষে। নামাজের সালাম ফেরানোর সাথে সাথেই এক হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনের শেলফে, কোরআন হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। এবার আমাকে একটু স্বার্থপর হতেই হলো। ভাবলাম যা করার উনি তিলাওয়াত শুরু করার আগেই করতে হবে। সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। নিজের পরিচয় দিলাম, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে হজরত খুশি হলেন। এরপর দুআ চাইলাম। দুটো স্পেশাল দুআ চাইলাম, হজরত আমিন বললেন! সেই সাথে হজরত নিজে থেকেই আরও কিছু দুআ করতে লাগলেন। হাসি হাসি মুখে কি দুআ করছিলেন হজরত, আমি ভালো করে শুনতে পাইনি, খুশির একটা ঘোরের মধ্যে কেবল বলে যাচ্ছিলাম, আমিন! আমিন! আমিন! দুআ শেষ করেই হজরত হাতে থাকা কোরআন খুলে বসলেন, ট্রেনটা ছুটেই যায় কিনা। এবার আর বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না ভেবে উঠে এলাম। যাওয়ার পথে ফিরে ফিরে দেখছিলাম শায়খকে, চোখে তখনও অবিশ্বাস। এরকম একজন মানুষের সাথে দেখা হবার, দুআ চাওয়ার সুযোগ কিভাবে পেলাম? মসজিদের এতো দরজা থাকতে, আমরা কিভাবে একই গেটে একত্রিত হলাম দুপুরে? আবার ঐদিনই এশার পরেই, এই সুবিশাল মসজিদের এতো জায়গা থাকতে, কিভাবে ঠিক পাশাপাশিই আল্লাহ দাঁড় করালেন আমাদের? আল্লাহ তাআলা যেন বুঝিয়ে দিলেন, আল্লাহ যদি দিতে চান, তিনি কারও যোগ্যতার পরোয়া করেন না। যোগ্যতা ছাড়াও তিনি দেন, চাইলেই দেন। আবার কখনো না চাইতেও দেন। আল্লাহর রহমতের কাছে কিছুই অসম্ভব নয়। আমার মতো অলস, অযোগ্য, অপদার্থ বান্দাকেও আল্লাহ এতটা ভালোবাসতে পারেন, কাছে টানতে পারেন, উপহার দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারেন! কিভাবে করবো এর শুকরিয়া? কিভাবে আল্লাহকে জানাবো কৃতজ্ঞতা? ভাষা নেই। শুধু সেই শব্দগুলো ছাড়া, যা তিনিই শিখিয়েছেন তাঁর বান্দাদের .....
الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

---------------------------------------------------------------------------------------------------

Sunday, August 06, 2017

নূরের শহরে (২) - উপহারের রাত

আমাদের হোটেলটা ছিল একেবারে মসজিদে নববীর চত্বর ঘেঁষে। মধ্যরাতের পর যখন পৌঁছলাম, এশার নামাজ তখনও বাকি আমাদের। সবাই খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেমে এলাম। মদিনার ঠান্ডা ঠান্ডা রাতের আবহাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম মসজিদের বাইরের সাদা চত্বরে। কতদিন পর আল্লাহ আবার নিয়ে এলেন। ১৫ বছর আগে, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি, বাবা মা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের ৩ ভাই বোনকে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেই খুব মনে পড়তো এই শুভ্র, শান্তিময় খোলা চত্বরটার কথা। আবারও বাবা মায়ের হাত ধরেই এলাম এবার। আলহামদুলিল্লাহ। এই নিয়ামত আল্লাহ আরও অনেক অনেক বাড়িয়ে দিন। আমিন।

আমাদের ছোট জামাতটার ইমাম হয়ে নামাজ পড়ালাম। হুজুর হুজুর দেখতে হওয়ার কারণে, আর কয়েক পারা মুখস্ত থাকায় প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় নামাজ পড়াতে হয়। এমনকি ঢাকার এক মসজিদেও একবার ফজরের নামাজ পোড়ানোর তৌফিক হয়েছিল, কোনো এক ৩ দিনের জামাতে থাকার সময়! কিন্তু এবারের এই নামাজ পড়ানোটাই আমার কাছে সবচেয়ে স্পেশাল ছিল, কারণ এবার দাঁড়িয়ে আছি মসজিদে নবনীর দেয়াল ঘেঁষে! তবে খুশির সাথে ভয়টাই বেশি ছিল সেই সময়। দাঁড়িয়ে আছি কোথায়! এই জায়গায় নামাজ পড়ানো কি, নামাজ পড়তেই তো বুক কাঁপার কথা আমার মতো মানুষের। মানুষকে নাহয় ধোঁকা দিয়েছি দাড়ি আর টুপি দিয়ে, বড় বড় নসিহত দিয়ে। আল্লাহ তো জানেন, ভেতরের খবর! আল্লাহ মাফ করুন, কবুল করুন। 

বাবা মা সহ আমদের সাথের বাকি ৩ জনেরও বয়স যথেষ্ট। বিশেষ করে বাবা মা সারাদিনের সফরের পরে একেবারেই ক্লান্ত তখন। ওই সময় তাদের সবচেয়ে প্রয়োজন ভালো একটা রেস্ট। ফজরেও তো উঠতে হবে। তাই সবাই ঠিক করলেন হোটেলে ফিরে যাবেন। যিয়ারতের জন্য অনেক হাটা প্রয়োজন, সেই শক্তি কারো শরীরেই নেই তাদের, থাকার কথাও না। কিন্তু আমি? মসজিদে নববীর দরজা থেকে ফিরে যাবো ভেতরে না ঢুকেই? আমার কি এতটা ক্লান্তি আসার কথা ত্রিশ বছর বয়সে? মসজিদের দালানের অপর প্রান্তেই তো শুয়ে আছেন আমার নবী (স) । যদি প্রশ্ন করে বসেন যখন দেখা হবে, কিরে, সেদিন এতো কাছে এসেও ঘুমুতে চলে গেলি? সালাম দিয়ে গেলি না? আমার চেহারা তুই দেখবি না অবশ্য, কিন্তু আমি তো তোর চেহারাটা দেখতাম! তোর হাসি আর কান্না মাখা মুখটা দেখতাম। তোর সালামের জবাব দিতাম! 

বাবা মা-কে জানালাম, আমি তো যিয়ারত না করে যেতে পারছি না। উনারাও সেরকমই এক্সপেক্ট করেছিলেন বোধহয়। বাবাই দেখিয়ে দিল 'বাবুস সালাম ' এর রাস্তা। আল্লাহ তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করুন।

মসজিদের বাইরের সাদা চত্বর তখন অনেকটাই ফাঁকা, হালকা সাদা আলোয় আলোকিত। তবে দূর থেকে যখন বাবুস সালামের খোলা দরজাটা চোখে পড়লো, ভেতরের সোনালী আলো যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে। বাইরের রাতের আলোয় মসজিদের চত্বর আর দেয়ালের মাঝে, সেই খোলা দরজাটা থেকে যেন উপচে পড়ছে সোনালী আলো! আমার মতো সাধারণের চোখে তো কেবল ভেতরের ঝলমলে ঝাড়বাতির আলোই চোখে পড়ে, তবে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা নিশ্চয়ই অন্য কোনো আলো দেখতে পান! নিশ্চয়ই!

মসজিদের এই গেটে সবসময় মানুষের স্রোত। এই গভীর রাতেও তার ব্যতিক্রম নেই। মানুষের স্রোত চলছে সামনের দিকে, যত সামনে আগাচ্ছি, চাপ ততই বাড়ছে। হবারই তো কথা। প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (স) তো মাত্র কয়েক কদম দূরেই! উনাকে সালাম জানানোর এই মিছিল চলছে, চলবেই। যতদিন দুনিয়াতে থাকবে তাঁর অনুসারীরা, তাঁকে মহব্বতকারীরা।

ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে পবিত্র রওজা মুবারাক। অল্প কিছু সামনেই সবুজ-সোনালী জালি। আরও কিছু পা, আরও একটু কাছে। আশেপাশের প্রতিটা মানুষের মুখে তখন দরূদ ও সালামের ধ্বনি, সেই সাথে কান্নার আওয়াজ। দরূদ, দুআ আর কান্না মিলে একটা মৃদু গুঞ্জন। কারো কান্না চাপা, কারওটা জোরে, আর কারওটা বাঁধ ভাঙা! আর আমারটা?

নবীজির রওজা চলে এলো। মানুষের স্রোত অনবরত লেগে থাকার কারণে এখানে দাঁড়াতে দেয়া হয় না বললেই চলে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম প্রিয় হাবিবকে, ভেজা চোঁখে। সালাম দিলাম তাঁর দুই প্রাণ প্রিয় সঙ্গীকেও। সে সময়ের অনুভূতির বর্ণনা দিতে যাচ্ছি না, দিতে পারবোও না। আবেগ প্রকাশের সে পরিমান দক্ষতা আমার নেই। শুধু বলবো সালাম শেষে দরজা দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি, দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। এতুটুকু পানি ঝরাতে পারাও আল্লাহর নেয়ামত, অনেক বড় নেয়ামত আমার মতো অযোগ্য বান্দার জন্য। 



যিয়ারত করে হোটেলে ফিরে যাওয়ার অলস নিয়ত ছিল, কিন্তু 'দিল' মানলো না, জোর করে আবার ঢুকিয়ে দিলো মসজিদে, একই পথে। কিছুদূর আগাতে দেখি এক জায়গায় অনেক মানুষের জটলা, সবাই যেন সামনের দিকে কোথাও যেতে চাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো যিয়ারতের লাইন নয়। একটু পরে বুঝতে পারলাম। মসজিদে নববীর মিম্বার আর রওজার মাঝের অংশটাকে প্রিয় নবী (স) জান্নাতের টুকরা বলে গেছেন। এই জায়গাকে 'রিয়াদুল জান্নাহ' বলে। জান্নাতের বাগান। এখানে দু রাকাত নামাজ পড়ার জন্য, একটু হাত উঠিয়ে দুআ করার জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে সারাক্ষণ। রাত তখন দুটারও বেশি বাজে বোধহয়। এখনও কত মানুষ! কি মনে হলো জানিনা, মানুষের ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম।

খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছে বান্দাদের স্রোত। রিয়াদুল জান্নাহর সীমানা কোনো দেয়াল দিয়ে ঘেরা না, খোলাই। তবে চিহ্নিত করা আছে কার্পেটের ভিন্ন রং দিয়ে। মসজিদের বাকি সব অংশের কার্পেট লাল, এই ছোট অংশটা হালকা সবুজ। যারা সুযোগ পাচ্ছে ভেতরে একটু নামাজ পড়ার, তারা খুব সহজে জায়গা ছাড়তে চায় না। আর না ছাড়লে পেছনের বেচারারাও সুযোগ পায়না। এজন্যই এই ধীর গতি। তবুও এগোতে লাগলাম অল্প অল্প করে। এভাবেই প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে গেলো।

বামপাশে তাকিয়ে দেখলাম রাসূল (স) এর রওজার দেয়াল একসময় প্রায় বরাবর এসে গেলো। আরও এগোলাম, খুব ধীরে। মুখে কেবল দরূদ পরে যাচ্ছি। হঠাৎ পায়ের নিচে তাকাতেই দেখি, লাল কার্পেট নেই, সবুজ! আমি ঢুকে গেছি জান্নাতের বাগানে! খুব দ্রুত একটু খানি জায়গা পেয়ে গেলাম। মসজিদের মুয়াযযিন সাহেবের আযান দেয়ার একটা উঁচু প্ল্যাটফর্ম আছে, আমি জায়গায় পেলাম এই প্ল্যাটফর্মের পিলার ঘেঁষে। দুই রাকাত নামাজ পড়লাম, বেশি সময় না নিয়ে। দুআ করলাম হাত তুলে, সেটাতেও খুব দেরি করলাম না। এই পবিত্র জায়গায় এসে কে উঠে যেতে চায়? কে চায় নামাজকে, দুআকে সংক্ষিপ্ত করতে? কিন্তু ওই আমার বামপাশে যিনি শুয়ে আছেন, যার মহব্বতে এখানে ছুটে আসা, উনিই তো বলেছেন, ভাইয়ের জন্য তাই ভালোবাসো, যা নিজের জন্য ভালোবাসো! আমার কত ভাইয়েরা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, অধীর অপেক্ষায়। এই একটু সুযোগের জন্য। আমি একটু আগেই ছিলাম তাদের স্থানে, আমি জানি তাদের দিলের অবস্থা। তাই মনের তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, বসে থাকলাম না, আর নামাজের নিয়ত করলাম না। উঠে দাঁড়ালাম বেরিয়ে গিয়ে আরেকজনকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য।

কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা যে ভিন্ন ছিল, সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না!

দাঁড়ানোর সাথে সাথেই শুরু হলো আযান! সুবহানাল্লাহ! কি সুন্দর, অপার্থিব আযান ! কিন্তু এখনও তো ফজরের অনেক বাকি, তবে এটা কিসের আযান? বুঝতে পারলাম একটু পরেই, এটা 'কিয়ামুল লাইল' বা তাহাজ্জুদের আযান। আরও আশ্চর্য হলাম এই দেখে রিয়াদুল জান্নাতের প্রবেশ পথগুলো আটকে দেয়া হলো, বাইরে থেকে আর কেউ ঢুকবে না। আজানের সাথে সাথে রিয়াদুল জান্নাতে আর ঢোকা যায় না, চাইলে বের হওয়া যায়। তারমানে এখন বেশ কিছুক্ষনের জন্য 'জান্নাতের টুকরার' এই ছোট জায়গাটা আমার, কেউ বের করে দিবে না! নিজের সৌভাগ্য বিশ্বাস করতেও বেশ কিছুক্ষন সময় লেগে গেলো। ঘোর কাটতেই জামাত দাঁড়িয়ে গেলো কিয়ামুল লাইলের জন্য।

তিলাওয়াত শুরু হতেই পেয়ে গেলাম আরও একটা উপহার। ছোট বেলা থেকে যাদের তিলাওয়াত মনের মধ্যে গেথে আছে, অনেক নতুন জনপ্রিয় ক্বারীদের ছাপিয়ে যাদের তিলাওয়াতই বারবার শুনতে থাকি, আমার কাছে সেরকম একজন প্রিয় ক্বারী হলেন মসজিদে নববীর প্রবীণ ইমাম, আলী আব্দুর রহমান আল হুযাইফী। মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল, এবার যেন মদিনায় উনার নামাজ পাই। আর সেটা পেয়ে গেলাম একেবারে প্রথম থেকেই! সেই পরিচিত আওয়াজ কানে আসতেই কান্না এসে পড়লো। কত গাম্ভীর্যপূর্ণ সেই তিলাওয়াত, কত স্পষ্ট মাখরাজ, কতটা নিখুঁত, consistent তাজবীদ। সত্যিই বলেন আল্লাহওয়ালারা, মক্কা-মদিনায় এসে, এরকম দু'রাকাত নামাজ পড়লে, মনে হয় যা কিছু খরচ হয়েছে সব উসুল। মুগ্ধতায় উপভোগ করলাম সেই নামাজ।

কিয়ামুল লাইল শেষ হলো, ফজরের আজানের তখনও কিছু সময় বাকি। ভাবছিলাম এখন বোধহয় ছেড়ে দিতে হবে জায়গা। কিন্তু না, কারও কোনো মুভমেন্ট দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, জান্নাতের বাগানে থাকার সৌভাগ্য আরো বর্ধিত হচ্ছে। দুআয় লেগে গেলাম এবার, মন খুলে, প্রাণ ভরে দুআ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই আজান পড়লো ফজরের। নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। ফজরের জামাতে আবারো কারী হুযাইফীর তিলাওয়াত, আবারও কান্না, আবারও মুগ্ধতা।

সব সুন্দর সময় শেষ হবেই দুনিয়ার জীবনে। আল্লাহর প্রতি এই দুই ঘন্টার জন্য যতই কৃতজ্ঞতা জানাই, সেটা যথেষ্ট হবে না কখনোই। আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে সামনের দিকে দিয়ে বের হয়ে এলাম রিয়াদুল জান্নাহ থেকে। প্রিয় নবীজির যিয়ারত, রিয়াদুল জান্নাতে অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ এই সুযোগ, সব মিলে এই রাতটা ছিল একটা স্বপ্নময় রাত। নবীর দরজায় অভ্যর্থনার, উপহারের রাত।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

হোটেলে ফিরে এসে বেশিক্ষণ ঘুমানোর সময় পাইনি, নাস্তার সময় হয়ে গিয়েছিলো। আমার রুমমেট ছোট ফুপা টের পেয়েছেন আমি সারা রাত রুমে আসিনি। সেই সুবাদে বাবা মা-ও জেনে গেছে। নাস্তার টেবিলে তাই তারা একটু থমথমে। চিন্তিত, এই ছেলে যে এই কয়দিন আর কত কি পাগলামি করবে!

Friday, February 24, 2017

চশমাটা খসে গেলে....

চশমা পড়ি সেই ছোট্ট বেলা থেকে। একেবারে ছোট বয়স থেকেই আমার চোখের সামনে দুটো কাচের টুকরো থাকে সবসময়, অন্তত জাগা অবস্থায়। ৫-৬ বছর বয়সে আমার সেই প্রথম চশমা-পড়া চেহারার বেশ কিছু ছবি আছে এখনো। আমি নাকি সেই চশমা আবার একটু পরপর নাক লম্বা করে, ভ্রূ উঁচু করে এডজাস্ট করতাম। সেটা নিয়ে এখনো প্রায়ই হাসাহাসি হয় বাসায়। সেই চশমাটা এখনো আছে আমার ড্রয়ারে। গোছাতে গিয়ে যখন মাঝে মাঝে হাতে আসে ওটা, কিছুক্ষনের জন্য থেমে যেতেই হয়, হাসি পায়। 

সেই যে চশমা ঝুললো চোখে......


চোখের পাওয়ার কমতে কমতে, আর চশমার পাওয়ার আর দাম বাড়তে বাড়তে এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা রীতিমতো দুঃখজনক। বিশেষ করে বাম চোখটার অবস্থা এতই খারাপ যে এটা লেজার ট্রিটমেন্টের অযোগ্য বলে দিয়েছেন এক ডাক্তার। তবে সবসময় চশমা হাতের কাছে থাকে বলে, এটার অভাব বা আমার শোচনীয়তার পরিমানটা টের পাইনা খুব একটা। তবে যখন টের পাই, বেশ অসহায় লাগে।

এরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়েছিল সুন্দরবনে। সেটা ছিল আমাদের আহসানুল্লাহর ব্যাচের ফেয়ারওয়েল ট্রিপ, একশো জনের উপর ছাত্র ছাত্রী নিয়ে। প্রচন্ড exciting সেই ট্রিপ এর কাহিনী লিখেছিলাম আগে একবার। তো সেবার কটকা বীচে, দোস্তদের সাথে সাগরের পানি দাপাদাপিতে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত অনিন্দ বললো, ঢেউ আসলে ঢেউয়ের নীচে মাথা দে, মজা লাগে। তাই নাকি? ট্রাই করে দেখা লাগে। মিডিয়াম সাইজের একটা ঢেউ আসতে দেখে ডুব দিলাম, মাথার উপরে ভেঙে পড়ল পানির টিলা। একটু পরেই আবার পানি সরে যেতে লাগলো যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে।ভুল বলেনি, আসলেই মজা। পানির উপর মাথা উঠিয়ে চিন্তা করছি আবার একটা দেয়া লাগে, কিন্তু মনে হলো, কি যেন একটা সমস্যা আছে। Something's not right. বেপারটা বুঝলাম একটু পরেই। আমার চশমা নাই। ঢেউয়ে ভেসে গেছে! আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বীচে উঠে আসলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ চশমা ছাড়া আমি এতটাই কানা যে রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করে। চশমার এক জোড়া স্পেয়ার ছাড়া কখনোই কোনো সফরে বের হয়নি, সেবারও না। তবে সেটা ছিল লঞ্চে, ব্যাগের ভেতর। স্টেইন্ড গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখার মতো বন্ধুদের শুধু ভৌতিক অবয়বগুলো দেখতে লাগলাম, পানিতে নেমে উদ্ভট কিসব যেন করছে। বেশ কিছু পরে লঞ্চে ফিরে আবার 'প্রাণ' ফিরে পেলাম চোখে।

কয়েকদিন আগে আবারো সেই অসহায়ত্বের একটা ছোট ডেমো পেলাম। কাহিনী যদিও সিম্পল। মিরপুরে IELTS ক্লাস নেয়া শেষে এশার নামাজ পড়বো মসজিদে। জামাত শেষ বেশ আগেই। ওযুর সময় আমি সবসময় চশমাটা ঝুলাই পিছন দিকে, মানে দুই কাঁধের মাঝে, জামার সাথে। ওযু শেষে চশমা পেছনে ঝুলিয়ে রেখেই মসজিদে ঢুকলাম। মসজিদের একেবারে সামনে কিছু লাইট ছাড়া বাকিগুলো অফ। পিছনে এক পাশে জুতা রাখার জন্য নিচু হতেই চশমাটা পরে গেল কার্পেটের উপর। ডার্ক লাল রঙের কার্পেট, তার উপর কালো কাজ করা। এদিকে আলো কম কিছুটা। মাথা নিচু করে খুঁজতে লাগলাম। কোনো চিহ্ন নেই। পা দুটোকে সেন্টারে রেখে মাথা ঝুকিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলাম। No use. পেছনের কিছু মুসল্লি হা করে তামাশা দেখছে, হয়তো করুনা নিয়ে, হয়তো না। আত্মসম্মান তাও কিছু বাকি ছিল তখনো। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়াতে লাগলাম, তখন সেটাও আর বাকি থাকলো না। তবে বেশিক্ষন এই অপমানজনক পজিশনে থাকতে হলো না, হাতে এসে বাজলো আমার precious চশমা।

পুরো ঘটনাটা খুব অল্প সময়ের, আর তেমন একটা সিগনিফিক্যান্ট কিছুনা, তবুও আমার অনেক হাসি পেলো। বেশ কিছু অনুভূতি খেলে গেল মাথায় একসাথে। প্রথমেই মনে হলো, দুটো স্বচ্ছ কাঁচের টুকরোর উপর আমি কত ডিপেন্ডেন্ট! আর ভাবলাম, আমি তো তাও চশমা পরে ঠিকঠাক দেখি, কত মানুষের তো সেই সুযোগও নেই! 


আর সেই সাথে ভাবলাম, আল্লাহ চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের সম্মানিত করতে পারেন, আবার সাথে সাথেই ছোট করতে পারেন। এই একটু আগেই ক্লাস ভর্তি ছাত্রের সামনে আমার কত পার্ট। আমি খুব ভালো ভাব নিতে পারি, ক্লাসে সেই যোগ্যতার পূর্ণ ব্যবহার করি, ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই তাই বয়সে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বেশ রেসপেক্ট করে। অথচ তার একটু পরেই, আল্লাহ আমাকে মসজিদের মেঝেতে গাধার মতো চার হাতপায়ে একটু ঘুরিয়ে নিলেন। কোথায় গেল ক্লাসের ঐ স্মার্ট আসিফ স্যার? 

আসলে আমাদের অহংকারের কিছুই নেই। নিজেদের অবস্থার উপরে বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই। সর্বাবস্থায় আমরা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। সেটাই আল্লাহ মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেন। মনে যে করিয়ে দেন সেটাতেও আল্লাহরই শুকরিয়া, উনি তার মানে ভাবছেন আমার কথা? আর তাঁর মনে পড়ানোতেও যে আমাদের মনে পড়বে তাঁর কথা, সেটাও তাঁর ইচ্ছায়। কত মানুষ আল্লাহর দেখানো বড় বড় ইঙ্গিতেও অন্ধ থেকে যায়। আল্লাহ যে আমাকে বাইরের এবং ভেতরের চোখে পুরো অন্ধ করেননি, তাই শুকরিয়া। আল্লাহ আমাদের দৃষ্টিকে আরো স্পষ্ট করে দিন। আমীন।

Wednesday, February 03, 2016

Teaching & Purification: the Two Prophetic Tasks

[From The Humble "I"]

The Prophet ﷺ once said: ‘I am the prayer of my father Abraham and the glad tidings [proclaimed by] Jesus to his people, and the vision of my mother who, while pregnant with me, saw a light issue forth from her which lit up the castles of Syria.’1
The good news of Jesus, referred to above, is mentioned in the following verse of the Qur’an: And [recall] Jesus, son of Mary, who said: ‘O Children of Israel, I am the Messenger of Allah to you, confirming that which was before me in the Torah and bringing good news of a Messenger who will come after me, whose name is Ahmad.’ [61:6]
As for Abraham’s prayer, peace be upon him, the Qur’an says: ‘Our Lord! Raise among them a Messenger from them who shall recite Your signs to them and teach them the Book and the wisdom, and purify them. You are the August, the Wise.’ [2:129]
Allah’s response to His khalil’s prayer is: He it is who has sent among the unlettered ones a messenger of their own, to recite to them His signs and to purify them, and to teach them the Book and the wisdom, though before they were in manifest error. [62:2]

The above hadith and verses highlight some weighty considerations for our faith and spiritual growth; these include:
1. That our Prophet ﷺ was commissioned with two principle tasks: teaching (ta‘lim) and purification (tazkiyah): teaching us revealed knowledge about God, divinity and the afterlife; and purifying souls from the vices of idolatry (shirk), disbelief (kufr) and heedlessness (ghaflah) of the revealed commands and the Divine Presence.
2. Although Abraham put ta‘lim before tazkiyah in his supplication, Allah responded with tazkiyah first, then ta‘lim. Again in the Qur’an, Allah puts tazkiyah first: We have sent to you a Messenger from among you, to recite to you Our signs and purify you, teach you the Book and the wisdom, and teach you that which you knew not. [2:151] This tells us that purification has a distinction over teaching, and that the former is the goal while the latter is the necessary means.
3. That knowledge must be coupled with action – which is a sign that the purification process is underway – is borne out by the following salaf-reports: From Ibn Mas‘ud, may Allah be pleased with him, who repeatedly insisted: ‘O people, learn! Whosoever learns, then let them act.’2 The venerable sage, Sahl al-Tustari remarked: ‘Knowledge, all of it is of the world; that of it which is of the Hereafter, is action upon it.’3 And Abu Qilabah, a traditionist and pietist of Islam’s second century, stated: ‘When Allah gives you knowledge, give to Him worship; and let not your desire be to merely narrate it to the people.’4
4. In the context of knowledge and purification, the Prophet ﷺ stated: ‘Two qualities shall never coexist in a hypocrite: good character and understanding of the religion.’5 In other words, a hypocrite may acquire a sound, theoretical knowledge of Islam, but it won’t be reflected in piety, character or demeanour. Or it could be that a hypocrite might have a graceful character, but will lack a sound understanding of faith. It is only with the true believer that a sound understanding (fiqh) of the religion is united with righteous action and inward illumination of the soul. So knowledge in itself does not save: unless it is translated into piety, concern for beautiful character, compassion for creation and, ultimately, seeking Allah and the afterlife.
5.  As the monoculture puts Muslim distinctness under greater siege, we must ensure that the Quranic purification always remains at the heart of the Islamic story and its engagement with modernity. That any meaningful diversity is now seen as potentially destabilising to social cohesion simply serves to prove liberalism’s intolerance, as well as its growing totalitarian nature. Tawhid is told to not be so judgemental upon shirk. The Abrahamic odyssey is required to make way for the new Nimrods: the new lords of misrule. Monotheism is put on notice and told to bow down to Babylon. Pressures such as these will, regrettably, produce victims – except if my Lord has mercy. [12:53] For conformity is part of human nature. But a browbeaten Muslim who reluctantly gives in or capitulates isn’t the same as the ever growing cadre of Muslims who are anxious to please and who play fast and loose with revealed principles. Where we cannot live up to the social demands of faith, let us admit our own weaknesses and implore Allah for forgiveness, courage and strength. We cannot twist revealed truths, or water them down, or adulterate them just to fit in, gain acceptance, or curry favour. For as far as faith and hope are concerned, better a sinner than a sell-out.
6. Keeping the two core prophetic tasks firmly in mind, we need to be mindful about any activism or call to action which seeks to eclipse them or deflect the ummah away from them. In fact, all socio-political activism must be subordinate to these two tasks. Those who have lost sight of these core concerns should be gently and wisely guided back to them. The Prophet ﷺ said: ‘Salvation for the first part of this nation is with certainty (yaqin) and worldly renunciation (zuhd); destruction of the last part of this nation is by miserliness (bukhl) and [lengthy] hopes (amal).’6 Munawi said: ‘Meaning that the earlier ones adorned themselves with certainty and worldly detachment and purged themselves of miserliness and hopes. This was a cause for their salvation from perdition. In the latter times, the opposite will be the case.’7 He also wrote: ‘In it is a censure of miserliness and hopes (amal). But what is blameworthy is lengthy hopes, as has been said. As for hopes in themselves, they are necessary for the establishment of this worldly life.’8 Yaqin, certainty of faith, is the fruit of sound teachings, while zuhd is the outcome of the soul’s restraint; itself a fruit of purification.
7. As to the levels of faith and certainty, they are: (i) Faith via taqlid: where faith comes from taking it from an authority one trusts, without knowing the formal proofs for it. This is the faith of the lay people, and is easily susceptible to doubts. (ii) Faith through evidence (burhan): this is the fruit of learning formal proofs and discursive arguments. This is the faith of scholars and theologians. (iii) Faith via spiritual sight (‘ayan): this is where faith is the result of the heart having an abiding vigilance (muraqabah) of Allah. It’s the faith of those having reached the Station of Vigilance (maqam al-muraqabah). (iv) Faith via spiritual witnessing (mushahadah): it is where the heart witnesses Allah, as though seeing Him. This is the faith of the ‘arifun blessed with reaching the Station of Spiritual Witnessing (maqam al-mushahadah). The first level of faith can be fragile: the next three beget ascending degrees of conviction and certainty.9
8. Beware reformist Muslims aching to align Islam with current western sensibilities, desperate to erase any distinctness that may make the monoculture feel unsettled. Be mindful of Muslim preachers unhinged from the sanad tradition, unschooled in adab and spiritual wisdom, who conflate harshness and severity with piety, thereby helping to drive many a servant of God into the icy realms of Riddastan. Beware, also, of the Muslim activist adopting the Sunnah out of reaction, protest, desperation, insecurity, identity politics, or because he cannot discover what else he wishes to be. Experience repeatedly demonstrates that such a person is likely to be ‘an engine of tanfir, driving humanity away from Islam by turning it into a language for proclaiming his inward traumas.’10
9. Before finishing, this concern about ta‘lim and tazkiyah; teaching and purification: Be not like those who became fixated on demonstrating the correctness of Islam, but came to practice nothing of Islam itself. Be not like those who were busy proving the existence of God, but came to care nothing for God Himself.
10. Lastly, ta‘lim reveals that our age is frought with so much confusion. Tazkiyah tells us that souls have never been so prone to egotism or spiritual lethargy. Together they help us realise that the times call on us that we too, like Allah’s wali, be infused with a spirit of love. For loving Allah, the wali loves His purposes; and looking at creation with love, laments that the Lord is forgotten, His commands disobeyed, and His signs unheeded.

Allahumma habbib ilayna’l-iman wa zayyinhu fi qulubina, wa karrih ilayna’l-kufra wa’l-fusuqa wa’l-‘isyan, waj‘alna min al-rashidin. Amin.

1. Al-Hakim, Mustadrak, no.4175. It being a sahih hadith is shown in al-Albani, Silsilat al-Ahadith al-Sahihah (Riyadh: Maktabah al-Ma‘arif, 1988), no.1545.
2. Cited in al-Khatib al-Baghdadi, Iqtida’ al-‘Ilm al-‘Aml (Riyadh: Maktabah al-Ma‘arif, 2002), no.11.
3. ibid., no.20.
4. ibid., no.37.
5. Al-Tirmidhi, no.2684, and it is sahih due to its collective routes of transmission. See: al-Albani, Silsilat al-Ahadith al-Sahihah (Riyadh: Maktabah al-Ma‘arif, 1995), no.278.
6. Ibn Abi Dunya, Qasr al-Amal, no.20. Al-Albani graded the hadith hasan li ghayrihi in Sahih al-Targhib wa’l-Tarhib (Riyadh: Maktabah al-Ma‘arif, 2006), no.3340.
7. Fayd al-Qadir (Beirut: Dar al-Ma‘rifah, n.d.), 6:282; no.9256.
8. ibid., 6:282.
9. For a further discussion on these levels of faith, see: al-Bayjuri, Tuhfat al-Murid ‘ala Jawharat al-Tawhid (Cairo: Dar al-Salam, 2006), 90.
10. A.H. Murad, Commentary on the Eleventh Contentions (Cambridge: Quilliam Press, 2012), 66.